কি প্রেম কি ভালবাসা ভ্যালেন্টাইন্‌স ডে

কি প্রেম কি ভালবাসা ভ্যালেন্টাইন্‌স ডে! ভালবাসা দিবস বলে কথা! এমন একটি দিনে ভালবাসা বিষয়ে দু-চারটি কথা বলবোনা… তাকি হয়? তো চলুন না; কার ঝুলিতে কি জমা আছে, তাই নিয়ে ঝাপিয়ে পড়ি, যা না বললেই নয়। আজ্ঞে শুরুটা আমাকেই করতে দিননা মশাই… তারপর না হয় আপনার পালা… নিচে লিখতে থাকুন কার মনে কি আছে…? ভালবাসা আর প্রেম, একই বিষয়, নাকি ভিন্ন কিছু হয়? ভালবাসা আর প্রেমের মধ্যে সম্পর্ক কি? ব্যবধানইবা কি? ভালবাসা আগে, নাকি প্রেম আগে? এইরকম হাজারো প্রশ্ন মনে জাগে! যদিও এখন সত্য প্রেমের আকাল, এসব নিয়ে ভাবতেই আমি নাকাল। সন্তানের প্রতি মাতার ভালবাসা, পিতার ভালবাসা, মাতা-পিতার প্রতি সন্তানের ভালবাসা, ভাইয়ের প্রতি ভাইয়ের ভালবাসা, ভাইয়ের প্রতি বোনের ভালবাসা, বোনের প্রতি ভাইয়ের ভালবাসা, বোনের প্রতি বোনের ভালবাসা, মানুষের প্রতি মানুষের ভালবাসা। প্রতিটি ভালবাসাই আলাদা স্বকীয়তার স্বাক্ষ্য বহন করে। আবার কপোত কপোতির ভালবাসা… আহ্‌! হায় ইশ্ক! যা কিনা বিপরীত লিঙের প্রতি পারস্পরিক আকর্ষণে সৃষ্ট ভালবাসা, সেই থেকে প্রেম? নাকি প্রেম থেকে ভালবাসা? অনেকেই বলে থাকেন; ভাল লাগা থেকে ভালবাসা, তারপর প্রেম। আবার অনেকেরই মত; বিয়েতে প্রেমের সমাপ্তি, ভালবাসার শুরু। কেউবা বলেন- বিয়ে প্রেম-ভালবাসারই শেষ পরিণতি। এ যেন এক আজব গোলকধাঁধা! ভালোবাসা একমাত্র বিষয়, যা বিজ্ঞান এবং সাহিত্য-মানব সমাজের বিবর্তনের এই দুই সমৃদ্ধ ক্ষেত্রও বুঝতে নাকাল হয়েছে। আর আমি-আপনিতো ছাপোশা মনু। উঠতি বয়সী কোন তরুণ যখন প্রেম করে, তখন তার ৩৪’’ ইঞ্চি বুকের পাটাকে ফুলিয়ে মনে মনে ৪২” ইঞ্চির অনুভূতি নিয়ে রাস্তা মাড়িয়ে হেঁটে চলে দোর্দন্ড প্রতাপে। তখন মনে হয় সার্ট তার বুকটাকে কোন অবস্থাতেই আঁটকে রাখতে পারছেনা, তাই বুকের বোতামটা সবসময় খোলাই থাকে। তারা মনে মনে ভাবে; হায়রে বুড়ো-বুড়ি! তোমরা কতইনা ব্যাক ডেটেড। আমরা কত্তো আধুনিক স্টাইলে প্রেম করি, তোমরা কি এসব বুঝতে? কখনো বুঝবেওনা। আর তাই খামোখাই আমাদের প্রেমে বাঁধ সাধো। হায় প্রেম! হায় তরুণ প্রজন্ম! তোমরা কি জানো একসময় আমরা এই বুড়ো-বুড়িগণও এমনটাই ভাবতাম? বিজ্ঞানের চোখে ভালোবাসা- “পেরেন্টাল ইনভেস্টমেন্ট” “সারভাইভাল স্ট্রাটেজি” “ইনস্টীঙ্কট”। সাহিত্যের চোখে তা- “দিবস রজনী বেদনা”। ধর্মের চোখে- “ব্যভিচ্যার”। আধ্যাত্মবাদিদের চোখে- “সাধনা”। অবিবাহিত বাঙালী পুরুষের চোখে- “পটাবার জন্যে মেয়ে নেই, আর এই লোকটা তত্ব-জ্ঞান দিচ্ছে .. ।” অবিবাহিত বাঙালী নারীর চোখে- “কবে যে ঝোলার উপযুক্ত একটা কাঁধ পাওয়া যাবে” বিবাহিত বাঙালী পুরুষ- “ভালোবাসা পাঁক, যৌনতাটাই আসল ক্ষীর” বিবাহিত বাঙালী নারী- “আমি হতভাগিনী-কত মেয়ের কত কিছু হয়-আমারই কিছু হল না” ________________________________________ কবি বলেছেনঃ “ভালোবাসার সব থেকে বড় ট্রাজেডি হল; ‘আমরা তাকে চাই, যাকে আমরা ভালোবাসি। যে আমাকে ভালোবাসে, তাকে আমরা চাই না।” আর কে যেন বলেছেন; “তুমি যাকে ভালবাস, তার পিছনে ভালবাসার কাঙাল হয়ে ছুঁটোনা। যে তোমাকে প্রকৃতভাবে ভালবাসে, তার পুজো কর। তাকেই মনের মানুষ করে নাও। মনের মানুষ একজনই হয়, একের অধিক নয়। যার একজন মনের মানুষ নাই, পৃথিবীতে তার বেঁচে থাকাটা অর্থহীনই বটে। মনের মানুষ সেই, যার কাছে বিশ্বাসকে গচ্ছিত রেখে সাত সমূদ্র-তের নদী পাড়ি দেওয়া যায়। একদিন ভালবাসার জয় হবেই। মনের মানুষকে চিনতে ভুল করলে আঘাত পাবেই।” মনেতো হচ্ছে আমিই লিখে ফেললাম। নাকি আমার হাত দিয়ে লিখে গেলেন কোন এক মহা মনিষি? হতেও পারে! ________________________________________ প্রেম-ভালবাসার সাথে তাহলে মনের মানুষেরও একটা সম্পর্ক আছে। থাকবেইনা কেন? লালন সাই তাইতো গেয়ে গেলেন- মিলন হবে কত দিনে… আমার মনের মানুষেরও সনে…। বাংলা সিনেমার ইতিহাস থেকে পাওয়া যায়; “স্বর্গ হইতে আসে প্রেম, স্বর্গে যায় চলে।” ভালবাসার শেষ পরিণতি বিবাহের বছরের শেষ মাথায় ভারবাহী স্বামীর ভাষ্য; “স্বর্গ হইতে আসে প্রেম, নরক যায় জ্বেলে।” আবার আগুনে বিদগ্ধ বিরহী প্রেমিকের ভাষ্য; “প্রেম এক জ্বলন্ত সিগারেট”। ভাবুকেরা বলে থাকেন; প্রেম হচ্ছে চুলকানী! যতই চুলকাবে ততই মজা পাবে, পরে বুঝবে জ্বালা কতো! আহ্! প্রেম আবিষ্কৃত হয় ১১৭৪ সালে। ত্রুবাদুর-চূড়ামণি আন্দ্রিয়াস ক্যাপেলানাস সংজ্ঞা দেন; “বিপরীত লিঙ্গের মনুষ্যের সন্দর্শন ও তাহার সৌন্দর্য সম্পর্কে অহোরাত্র চিন্তনের ফলে হৃদয়ে যে বিশেষ জন্মগত বেদনা অনুভূত হয়, তাহাই প্রেম।”  ইহার কারণে উভয় লিঙ্গের মনুষ্যেরই প্রধান আকাঙ্ক্ষা হইয়া দাঁড়ায় অপরের আলিঙ্গন ও পরস্পরের পূর্ণ সম্মতিক্রমে প্রণয়ের অন্যান্য প্রকরণ অভ্যাস’। অর্ক চট্টরাজের ‘মধ্যযুগের চারণকবি’ গ্রন্থে অনূদিত এই বিখ্যাত সংজ্ঞার অনুরূপই পাওয়া যায়। বিজ্ঞান বহুদিন আগেই প্রেমকে দ্বিবিধ হরমোনের (‘সেরোমোন’ ও ‘রক্সিটোসিন’) ক্রিয়ার ফল বলে জানিয়েছে। যদিও পরবর্তীতে অবশ্য তার যথার্ততা প্রমাণিত হয়নি। নিলয় ঘোষ বৈষ্ণব পদাবলী উদ্ধৃত করে এবং রাজস্থানী মিনিয়েচার পেন্টিং স্লাইডে দেখিয়ে বোঝালেন প্রেমের গভীরতা আরো কত গভীর।যখন নায়িকা মুগ্ধা থাকে, অর্থাৎ প্রেমিকের অধরস্পর্শে চমকিতা, লজ্জাড়ষ্টা হয়ে মুখ সরিয়ে নেয় ও প্রত্যালিঙ্গন দেয়না, তখন তার সম্মতি ব্যতিরেকেই স্পর্শন স্তম্ভন প্রয়োগ করে তাকে ‘হ্লাদিনী’ স্তরে আনয়ন করতে হয় (যখন সে স্ব-উদ্যোগে নখরচিহ্ন খচিত করে প্রিয়ের দরাজ বক্ষে ও নির্লাজ বিপরীতরতাতুরা হয়ে পড়ে দ্বিতীয় প্রহরে), নইলে লীলা পূর্ণতা পায় না। শ্রীকৃষ্ণের বৃন্দাবন-জীবন আদতে এক ছদ্মবেশী (ভিন্ন ফর্মে লেখা) লাভ-সেক্স ম্যানুয়াল এই দাবী করে সুজাতা হাজরা প্রেমের মূল তিনটি পুরুষ-প্রতিশ্রুতি লিপিবদ্ধ করলেন। ১ . তব অঙ্গের কাঁচুলি মম করাঙ্গুলি। ২ . তুমি ঘুমঘোরে পাশ ফিরলে আমি মানভয়ে ভীত। ৩ . তোমার চর্ব্বিত তাম্বুল আমি খাব, দরিদ্রের ধনের মতো তোমায় কোথায় থুই ভেবে না পেয়ে অঙ্গে অঙ্গে ফিরাব, আগালি ঘাটে তুমি স্নান করলে পিছালি ঘাটে আমি নাইব, যাতে তব পরশিত জল আমার গায়ে বয়। সমাদ্দার পিয়ার-প্রেসারের (পেয়ার-প্রেসারের) কথাটাও বলে নিচ্ছেন।প্রেম হওয়া এখন আশ্চর্য দৈব বিদ্যুচ্চমক নয়, তা কম্পোলসারি। পুজোয় একলা ঠাকুর দেখতে যে বেরোয়, সে ক্যবলা। একা = বোকা। অনন্যা গঙ্গোপাধ্যায় বলেন, ‘সেক্স আর প্রেম যদি আলাদা জিনিস হয়, ওয়াটার ও জলই বা ভিন্ন বস্তু নয় কেন?’ অমূল্য গুহ মনে করিয়ে দেন ভলত্যায়ারের অমর উক্তি ‘সঁ ঝুর প্যর্স ত্রিকোলি আভোয়া মত্যাঞ ভ্রুর্ল’ : যৌনচেতনার মধ্যে থেকে বীর্যের মতো সহসা উৎক্ষিপ্ত হয় প্রেম, রাগমোচনের মতৈ তা কুলপ্লাবী, বিস্ফোরক, তাৎক্ষণিক ও অকিঞ্চিৎকর (ঈশোপনিষদে ৩ : ১২৪ : ৩২ নং শ্লোকে প্রায় আক্ষরিক এই কথাই বলা আছে দাবি করে বরুণাংশু মিত্র সম্পূর্ণ অন্য ধারার আলোচনার জন্ম দিতে চেয়েছিলেন ; সম্ভবত বিদ্বানদের সংস্কৃত-অজ্ঞানতার জন্য তা ধোপে টেকেনি)। এর মধ্যে লাফিয়ে পড়েন বিখ্যাত লেখিকা নির্মলা শী। তিনি বলেন,‘প্রেম মানেই শরীর কদাপি নয়, কিন্তু পুরুষের কাছে প্রেম মানেই শরীর। একমাত্র নারী প্রেমের মানে বোঝে। অবশ্য পুরুষ যৌনতারও মানে বোঝে না। প্রতিটি পুরুষই আসলে ধর্ষক’। দিগা মালহোত্রা’র উক্তি : “বাজি ফেলে বলছি, পুরুষের প্রেম নারীর স্তনের সাইজের সমানুপাতিক।” আমি বলি; ‘পুরুষের প্রেম নারীদেহের শৈল্পিক বক্রতা (সৌন্দর্য)’র সমানুপাতিক, আর নারীর প্রেম পুরুষের অর্থ ও পৌরষত্বের ব্যাস্তানুপাতিক। মহাকবিও বলে গেছেন; ‘প্রেম কীসে যে হয় কেউ কি জানে! কখনও চোখে চোখে, কখনও মনে মনে, কখনও আনমনে-এ-এ’। সন্দীপন পড়েননি, ‘যৌনতা প্রেমের মহাজন’? সর্বক্ষণ উদয়াস্ত তাকে ট্যাক্স শুধে যেতে হচ্ছে, বোঝো না? অতটা অশিক্ষিত নই যে বলব, যৌনতাই প্রেম। কিন্তু এতটা গামবাটও নই যে জানব না, মগজ বডিরই এক্সটেনসন। প্রণয়ে শরীরের চেয়ে মনের কৌলীন্য বেশি। ও সব সকালবেলার খ্যাঁচাকল, সভ্যতার জ্যালজ্যালে মলাট, চটচটে লেবেল। রাত্তিরের ব্যাকরণ আলাদা। এবং তা-ই তাবৎ ভণ্ডামির মুখে লাথ মারা, কাঁচা ব্যাকরণ। আঁধার বালিশে ব্রেন আর বাথরুমে ঢুকে সিভিলাইজেশনের নাকের উপর দরজা বন্ধ করে দিয়ে যা ভাবো, যা নিজে ছাড়া কারো কাছে স্বীকার করোনি, সে-ই সত্য। আঁশটে কিন্তু সত্য। অ্যান্ড দেয়ারফোর পবিত্র। শুধু তাই পবিত্র, যা ব্যক্তিগত।


Comments